আনারসের ১০টি আশ্চর্য উপকারিতা এবং ঔষধি গুণ জেনে নিন

আনারসের ১০টি আশ্চর্য উপকারিতা এবং ঔষধি গুণ জেনে নিন

আনারস বা Pineapple হলো একধরণের রসালো ও তৃপ্তিকর সুস্বাদু গুচ্ছফল। ফলটিতে আঁশ ও ক্যালরি ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ভিটামিন বি-৬, ফোলেট, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও বিটা ক্যারোটিন। এসব অপরিহার্য উপাদান দেহের পুষ্টির অভাব পূরণ করে। 

আনারস খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এর রয়েছে বিভিন্ন ঔষধি গুণ। এছাড়াও এটি কলস্টেরল ও চর্বিমুক্ত। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ ফলের জুড়ি নেই। এর বৈজ্ঞানিক নামঃ Ananas comosus (L.) Merr

আনারসের পুস্টিমূল্য

প্রতি ১০০ গ্রাম আনারসে রয়েছে-

উপাদানপরিমাণ
প্রাটিন০.৯ গ্রাম 
শ্বেতসার৬.২ গ্রাম
ভিটামিন বি-১০.১১ মি. গ্রাম
ভিটামিন বি-২০.০৪ মি. গ্রাম
ভিটামিন সি২১ মি. গ্রাম
ক্যালসিয়াম১৮ মি. গ্রাম
লৌহ১.২ মি. গ্রাম
ক্যারোটিন১৮৩০ মাই. গ্রাম

আনারসের উপকারিতা

আসুন আনারসের কিছু উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিই।

১। ভাইরাসজনিত ঠান্ডা কাশি প্রতিরোধে

আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকায় তা ভাইরাসজনিত ঠাণ্ডা ও কাশি প্রতিরোধে ভুমিকা রাখে। নাক দিয়ে পানি পড়া, গলাব্যথা এবং ব্রংকাইটিসের বিকল্প ওষুধ হিসাবে আনারসের রস খাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া  জ্বর ও জন্ডিস প্রতিরোধে আনারস বেশ উপকারী ভূমিকা রাখে। 

খালি পেটে আনারস খেলে কি হয়?

খালি পেটে সকালবেলা আনারস খাওয়া শরীরের জন্য উপকারী। আনারসে আছে এনজাইম ব্রমেলেইন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন সি। দুটো উপাদানই রোগ নিরাময়ে বেশ কার্যকর। অন্য রোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আনারস খাওয়া দরকার।

২। ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায়

আনারসে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার বা আঁশ পাওয়া যায়। আনারসের ফাইবার বা আঁশ গুলো দ্রবণীয় নয় অর্থাৎ পুরোপুরি হজম হয় না। হজম না হওয়ার ফলে আঁশ গুলো টাইপ – ২ ডাইবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে। তাই নিয়মিত আনারস খেলে ডাইবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। 

তবে যাদের ডায়াবেটিস হয়ে গেছে তাদের আনারস খাওয়া না খাওয়ার ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।

কারণ, আনারসে আছে অনেক বেশি পরিমানে প্রাকৃতিক চিনি। আনারসের ২ টি চিনি উপাদান সুক্রোজ এবং ফ্রুক্টোজ যা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। 

ডায়াবেটিস কমানোর ২২টি উপায় জানতে এখানে ক্লিক করুন।

গর্ভাবস্থায় আনারস খেলে কি হয়?

এছাড়াও, যারা গর্ভাবস্থায় আছে তাদেরকে ডাক্তারা আনারস খেতে নিষেধ করেন। কারণ এতে ব্রোমেলাইন নামক একটি এনজাইম রয়েছে যা দেহে প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত হলে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নারীদের বেশি পরিমাণে আনারস খাওয়ার কারণে পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তপাতের সমস্যাও দেখা দিতে পারে বলে ডাক্তাররা বলে থাকেন।

৩। শরীরের ওজন কমাতে সহায়তা করে

শুনতে অবাক লাগলেও আনারস আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। কারণ আনারসে প্রচুর ফাইবার এবং অনেক কম ফ্যাট রয়েছে। তাই ওজন কমাতে চাইলে নিয়মিত আনারস খাওয়া যেতে পারে চোখ বন্ধ করে। 

৪। কৃমি দমন করতে সাহায্য করে

ক্রিমিনাশক হিসেবে আনারসের রস ভালো কাজ করে। নিয়মিত আনারসের রস খেলে কয়েকদিনের মধ্যেই কৃমির উৎপাত বন্ধ হয়ে যায়।

কৃমি দূর করতে সকালবেলায় ঘুম থেকে জেগে খালি পেটে আনারস খাওয়া উচিত। আনারস খেলে কৃমি মরে যায়, কৃমি গুলো পেট থেকে বের হয় যায়।

কৃমি দমন করার সবচেয়ে ন্যাচারাল উপায় হচ্ছে আনারস। তাই কৃমি দমনে কিছুদিন পর পর আনারস খাওয়া যেতে পারে নিশ্চিন্তে।

অনেকেরই প্রশ্ন জাগে,

আনারস এবং দুধ খেলে কি হয়?

আনারস এবং দুধ নিয়ে একট বানোয়াট গল্প আছে যে, আনারস ও দুধ একসঙ্গে খেলে বিষক্রিয়া হয়। আনারস একটি অ্যাসিডিক এবং টকজাতীয় ফল। যে কোনো টকজাতীয় জিনিস দুধের মধ্যে দিলে দুধ ছানা হয়ে যেতে পারে বা ফেটে যেতে পারে। বদহজম, পেট ফাঁপা, পেট খারাপ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বিষক্রিয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

৫। ক্যান্সার প্রতিরোধ করে

মানবদেহের কোষের উপর ফ্রি-রেডিকেল বা মুক্ত মুলক বিরূপ ক্রিয়ার সৃষ্টি করে ফলে হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মত মারাত্মক রোগ দেখা দিতে পারে। 

উচ্চ মাত্রায় পানিতে দ্রবনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন-সি দেশী আনারসে রয়েছে। যা ফ্রি-রেডিকেল বা (মুক্ত মুলক) থেকে দেহকে সুরক্ষা প্রদান করে। ফলে ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মত মারাত্মক রোগের হাত থেকে বাঁচাতে সহয়তা করে।

আনারসে প্রোটিওলাইটিক নামক একটি এনজাইম রয়েছে, যা ব্রোমালিন নামে পরিচিত। পৃথিবীর খুব কম খাদ্য উপাদানে এই এনজাইমটি পাওয়া যায়। এই এনজাইমটি প্রোটিন ভাঙ্গতে সহায়তা করে এবং ক্যান্সার সেল ধ্বংশ করতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুনঃ বড়ই এর উপকারিতা – বরই এর ১৭টি উপকারিতা ও ঔষধি গুণ জেনে নিন

৬। উচ্চরক্তচাপ কমায়

এই ব্রোমেলিন উপাদানটি উচ্চরক্তচাপের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। অ্যাসপিরিনের বিকল্প হিসেবেও কাজ করে আনারস। এর অদ্রবণীয় ফাইবার বা আঁশ উচ্চরক্তচাপ কমাতেও সহযোগীতা করে।

৭। হাড়, দাতঁ, মাড়ি শক্ত করে

আনারসে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে যা হাড়ের গঠনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া এতে থাকা ম্যাঙ্গানিজ, যা হাড়কে করে তোলে মজবুত। মাড়ির সমস্যা ও দাঁতে জীবাণুর আক্রমণ কম হয়।

আনারসে ক্যালসিয়াম থাকায় তা দাঁতের সুরক্ষায় ও কাজ করে। নিয়মিত আনারস খেলে দাঁতে জীবাণুর সংক্রমণ কম হয় ফলে দাঁত ঠিক থাকে। এছাড়া মাড়ির যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে আনারস বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

তাই খাবার তালিকায় পরিমিত পরিমাণ আনারস রাখলে হাড়, দাঁত ও মাড়ির সমস্যাজনিত যে কোনও রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

তবে যাদের দাঁতে কেভিটিস ও জিংজাইভেটিভস এর সমস্যা আছে তাদের জন্য আনারস ক্ষতিকর।

৮। হাঁপানি দূর করে

হাঁপানি জনিত সমস্যায় ভোগে অধিকাংশ নগরবাসী। নোংরা, ধূলা-বালি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ হাঁপানি হওয়ার প্রধান কারণ। নিয়মিত আনারস খেলে হাঁপানি বা অ্যাজমা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যায়।

৯। হজম শক্তি বৃদ্ধি করে

আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করতেও আনারসের জুড়ি নেই। আনারসে ব্রোমেলিন নামক এনজাইম থাকে যা হজমশক্তিকে উন্নত করতে সাহায্য করে।

তাই বদহজম বা হজমজনিত যে কোনো সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আনারস খাওয়া যেতে পারে।

১০। চোখ ত্বকের যত্নে আনারস

আনারস চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাওয়া রোগ “ম্যাক্যুলার ডিগ্রেডেশন”রোগটি হওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করে। আনারসে রয়েছে বেটা ক্যারোটিন। প্রতিদিন আনারস খেলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে সুস্থ থাকে আমাদের চোখ।

এছাড়াও আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি থাকে যা আমাদের শক্তির যোগান দেয়। এতে থাকা প্রোটিন ত্বকের মৃত কোষ দূর করে, ত্বককে কুঁচকে যাওয়া থেকে বাঁচায়। এছাড়া দেহের তৈলাক্ত ত্বক, ব্রণসহ সব রূপলাবণ্যে আনারসের যথেষ্ট কদর রয়েছে।

আনারসের জুসেরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। চলুন জেনে নিই কিভাবে আনারসের জুস কিভাবে তৈরি করবেন।

আনারসের জুস তৈরি

সকালে আনারস বা সালাদ হিসেবে এর ব্যবহার অথবা আনারসের জুস অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। আনারসের জুস তৈরি করা খুব সহজ একটি বিষয়।

এর জন্য প্রয়োজন ২ কাপ ‏আনারসের টুকরা, ২ টেবিল চামচ ‏চিনি, ২ টি ‏কাচা মরিচ, পরিমানমত ‏বিট লবন, ৩ কাপ ‏পানি ও পরিমানমত ‏বরফ। এরপর একটি ব্লেন্ডারে আনারসের টুকরা, বিট লবণ, কাচা মরিচ, পানি, চিনি ও বরফ দিয়ে সবকিছু এক সাথে ভাল করে ব্লেন্ড করে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে আনারসের সুস্বাদু জুস। 

তবে অনেকে অনেকেই কাঁচা আনারস ব্যবহার করে থাকেন। জুস বানানোর জন্য কিন্তু এটি দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং খুব বিষাক্ত। মাঝে মাঝে কাঁচা আনারস খাওয়ার কারণে বমির প্রবণতা দেখা দেয়।

আনারসের উপকারিতা ও কিছু অপকারিতা সম্পরকে জানুন নিচের ভিডিও থেকে।

পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ রসালো এই ফলটির যেমন রয়েছে উপকারিতা তেমনি এর রয়েছে বেশ কিছু ঔষধী গুণ।

আনারসের ঔষধি গুণ

👉 নিয়মিত আনারসের রস বা শরবত খেলে উচ্চ তাপ এবং ঘামের সমস্যা কাটিয়ে ওঠে।

👉 আনারসে গোল মরিচ এবং কালো লবণের গুঁড়া মিশিয়ে খেলে বদহজমের সমস্যা শেষ হয়।

👉 আনারসের রস গলা ও মুখের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে উপকারী।

👉 আনারস গ্রহণের কারণে প্রস্রাবে বাধা সৃষ্টি হয় না এবং প্রস্রাব পরিষ্কার হয়। আনারস, জায়ফল, পিপুল, কালো লবণ এবং জিরা সম পরিমাণে নিয়ে সকালে ও সন্ধ্যাবেলায় তিন গ্রাম গুঁড়ো জল খেলে ডায়াবেটিসের সমস্যায় খুব উপকারী।

👉 ১০০ গ্রাম তাজা আনারসের রস শিশুকে নিয়মিত খাওয়ালে পেটের কৃমি (ক্ষুদ্র কৃমি) মরে যায় । তবে খালি পেটে আনারসের রস দেওয়া উচিত নয়।

👉 বদহজমের রোগীকে আনারসের উপরে গোল মরিচ গুঁড়া ছিটিয়ে, বিট নুন যুক্ত করে খাওয়া উচিত। তাহলে উপকার পাওয়া যায়।

👉 ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের অভাবে যদি স্কার্ভি হয় তবে আনারস খাওয়া এবং রস খাওয়া খুব উপকারী।

👉 আনারসের রস দেহে রক্তের অভাবের জন্য খুব উপকারী।

👉 যদি হার্ট নার্ভাস হয়ে যায় এবং গ্রীষ্মে আরও অস্বস্তি হয় তবে আনারসের রস বা সিরাপ পান করা খুব উপকারী।

👉 গলায় এবং টনসিলের ক্ষেত্রে যদি প্রদাহ হয় তবে আনারস খাওয়া খুব উপকারী।

আনারস সম্পর্কে আরও জানতে এই অথেনটিক আর্টিকেল পড়তে পারেন।

আনারস এমন একটি ফল যা সবখানেই চাষ করা যায়, এবং এর ক্রয়ক্ষমতা ও সাধ্যের মধ্যে। তাই আনারস বা আনারস জাতীয় যে কোন কিছু, সহজেই পূরণ করতে পারে ফলের চাহিদা। তবে আনারসের যেমন উপকারি দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু সাইড-এফেক্ট ও। তাই এই স্বসাদু ফলটি খাওয়ার আগে জেনে বুঝে খাওয়া দরকার।