শবে কদর : লাইলাতুল কদর নামাজ, আমল ও ফজিলত (Laylatur Qadr)

বছরে যে বারোটি মাস রয়েছে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস হচ্ছে রমজান মাস। আর রমজান মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যেই রাত সব রাত থেকে উত্তম এবং ফজিলতের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ সেই রাতটি হচ্ছে “শবে কদর” বা “লাইলাতুল কদর”এর রাত।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এই রাত সম্পর্কে উল্লেখ করেন এবং সূরা কদর নামে একটি সূরা নাজিল করেছেন। এই সূরাটিতে শবে কদরের রাতকে আল্লাহ তায়ালা সব রাত থেকে হাজার মাস উত্তম বলে অভিহিত করেছেন।    

আজকের আর্টিকেলে শবে কদর কি, শবে কদর কবে, শবে কদর নামাজের নিয়ম,শবে কদরের দোয়া ও লাইলাতুর কদর এর ফজিলত এবং সুরা কদর বাংলা অর্থসহ উচ্চারণ অডিও সম্পর্কে জানব। 

 

শবে কদরের অর্থ কি (Shob e Qadr)

শবে কদর বা লাইলাতুল কদর অর্থ হলো পবিত্র রজনী বা মহিমান্বিত রাত। শব শব্দের অর্থ রাত বা রজনী এবং কদর শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা,মহিমান্বিত। অর্থাৎ শবে কদরের অর্থ হলো মর্যাদার রাত। শবে কদর শব্দটি মূলত ফার্সি শব্দ। এর আরবি হচ্ছে ‘লাইলাতুল কদর’।

এই রাতেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল-কোরআন নাজিল করেছেন। সূরা আল কদর নামে কোরআন শরীফে একটি সূরা দিয়েছেন। যেখানে এই পবিত্র রাত সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।

শবে কদর সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তুমি কি জানো, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ (সুরা কদর, আয়াত: ১-৩)

শবে কদর কবে বা কখন (Laylatul Qadr)

শবে কদর আসলে কবে বা কখন সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। শবে কদর কবে তা নিয়ে অনেক মতবাদ রয়েছে।

হাদিস শরীফে এসেছে, তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবে কদর তালাশ করো।(বুখারি, হাদিস) । বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে রমজান মাসের ২৭ তারিখ শবে কদর পালন করা হয়।

রমজানের ২৭ তারিখ ই যে শবে কদর হবে তা নয়। নবী করিম (সা) বলেছেন, তোমরা শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর অনুসন্ধান করো। অর্থাৎ রমজান মাসের ২১,২৩,২৫,২৭,২৯ তারিখে এই মহিমান্বিত রাত তালাশের কথা বলা হয়েছে।  

আয়িশা (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেনঃ তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর। (সহীহ বুখারী)     

 

শবে কদরের নামাজের নিয়ম

শবে কদরের নির্দিষ্ট কোন নামাজ নেই। এই রাতে আপনি বেশি বেশি নফল নামাজ, তাসবিহ ও জিকির করতে পারেন যা হাদিসে এসেছে। কদরের রাতের একটি ইবাদাত এক হাজার মাসের থেকেও উত্তম। এই রাতটি ইবাদাতের মাধ্যমে অতিবাহিত করাই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য।   

হযরত আয়েশা (রা) বলেন: নবী (স) রমযানের শেষ দশ দিন যিকির ও ইবাদাতের এমন ব্যবস্থা করতেন যা অন্য সময়ে করতেন না। (সহীহ মুসলিম)

এ রাতে বেশি বেশি নামাজ, তাসবিহ, জিকির এগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে নবী করিম (সা) বলেন, যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহমত ও মাগফেরাতের দোয়া করেন যে দাঁড়িয়ে বসে আল্লাহর ইয়াদ ও ইবাদাতে মশগুল থাকে। (বায়হাকী) 

শবে কদরের রাত হচ্ছে বেশি বেশি আমল করার রাত। এবং আল্লাহ কাছে থেকে ক্ষমা চাওয়ার এবং ক্ষমা লাভ করার একটি বিরাট সুযোগ।

অনেকে মনে করে লাইলাতুল কদরের বিশেষ কোন নামাজ রয়েছে। আসলে লাইলাতুল কদরের বিশেষ কোন নামাজ নেই। লাইলাতুল কদর উপলক্ষে নামাযের জন্য বিশেষ কোন নিয়্যাতও নেই। এ জন্য সাধারণ সুন্নতের নিয়মে দুই রাকাত নফল পড়ছি। এ নিয়তে নামাজ শুরু করে শেষ করতে হবে।  ইশার নামাজের পর থেকে আপনি নফল নামাজ আদায় করতে পারেন।

নফল নামাজের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে তাহাজ্জুদের নামাজ। সালাতুল হাজত, সালাতুল তাসবিহ নামাযও পড়তে পারেন।

শবে কদরের দোয়া (laylatul qadr dua)

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহা বর্ণনা  করেন একদিন আমি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে জিঙ্গেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসুল আপনি আমাকে বলে দিন আমি শবে কদরের রাতে কোন দোয়া পড়বো? জবাবে তিনি এই দোয়াটি পড়তে বললেনঃ  

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي ।

বাংলায় উচ্চারণঃ –আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।–

অর্থ হলোঃ  হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (“মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত”)।

তাছাড়া আরও অনেক দুয়া রয়েছে যেগুলো আপনি করতে পারেন। যেমনঃ-

১। আরবিতেঃ  رَبِّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ فَاغْفِرْ لِيْ
উচ্চারণঃ “রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি”।

অর্থ হলোঃ (“হে আমার) প্রভু! নিশ্চয়ই আমি নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি, অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন”। (সুরা কাসাস: আয়াত-১৬)

২। আরবিতেঃ رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِيْنَ।

বাংলা উচ্চারণঃ  “রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন”।

অর্থ হলোঃ “হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার উপর রহম করুন, আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ রহমকারী।” (সুরা মুমিনুন: আয়াত-১১৮)

৩। আরবিতেঃ  رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ। 

বাংলায় অর্থঃ “হে আমাদের প্রভু! সুতরাং আমাদের গোনাহগুলো ক্ষম করুন। আমাদের ভুলগুলো দূর করে দিন এবং সৎকর্মশীল লোকদের সাথে আমাদের শেষ পরিণতি দান করুন”। (সুরা আল-ইমরান: আয়াত-১৯৩)

৪। আরবিতেঃ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ।

বাংলায় উচ্চারণঃ “রাব্বানা ইন্নানা আমান্না ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া ক্বিনা আজাবান নার”।
বাংলায় অর্থঃ “”হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং তুমি আমাদের গোনাহ ক্ষমা করে দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর””। (সুরা আল-ইমরান: আয়াত-১৬)

৫। আরবিতেঃ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ।

বাংলায় উচ্চারণঃ “”রাব্বানাগফিরলানা ওয়ালি ইখওয়ানিনাল্লাজিনা সাবাকুনা বিল ঈমানি””।
বাংলায় অর্থঃ “হে আমাদের প্রভু! আমাদের ক্ষমা করুন এবং যারা আমাদের আগে যারা ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, তাদেরকেও ক্ষমা করুন”। (সুরা হাশর: আয়াত-১০)

চলুন দেখে নিই সুরা কদর বাংলা অর্থসহ উচ্চচারণ অডিও সহ।

সূরা কদর (surah qadr)

সূরা আল কদর পবিত্র কোরআনের ৯৭ তম সূরা। সূরাটির আয়াত সংখ্যা ৫ টি। সুরা কদর মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এই সূরাতে এমন একটি রাতের কথা বলা হয়েছে যা হাজার মাসের রাতের চাইতে উত্তম। সেই রাতটি হলো “লাইলাতুল কদর” বা “শবে কদর” অর্থাৎ মহিমান্বিত রাত। তাই  আমাদের উচিত এই রাতে বেশি বেশি ইবাদাত করা ও তাওবা করা।

সুরা কদর বাংলা অর্থসহ উচ্চারণ (surah qadr bangla)

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

অর্থঃ শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

(১)

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ

উচ্চারণঃ ইন্নাআনঝালনা-হু ফী লাইলাতিল কাদর।

অর্থঃ আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে।

(২)

وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ

উচ্চারণঃ ওয়ামাআদরা-কা-মা-লাইলাতুল কাদর।

অর্থঃ শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন?

(৩)

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ

উচ্চারণঃ লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর।

অর্থঃ শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

(৪)

تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ

উচ্চারণঃ তানাঝঝালুল মালাইকাতুওয়াররুহু ফীহা-বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমর।

অর্থঃ এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।

(৫)

سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

উচ্চারণঃ ছালা-মুন হিয়া হাত্তা-মাতলা’ইল ফাজর।

অর্থঃ এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

সূরা কদর অডিও (surah al qadr audio)

শবে কদরের আমল (shob e qadr)

শবে কদরের রাতে বেশি বেশি ইস্তেগফার পাঠ করুন। সাইয়েদ্যুল ইস্তেগফার হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম। দুরুদ শরীফ পাঠ করা। অতীতের সব গুনাহ ও ভুল-ত্রুটির জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। অধিক দান-সদকা করুন।

কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করুন (বিশেষ বিশেষ সূরা তিলাওয়াত করা যেমন, সূরা আল- কদর, সূরা আল-মুদ্দাসির, সূরা দুখান, সূরা আর-রাহমান, সূরা ইয়াসিন, সূরা ত্ব-হা, সূরা ওয়াকিয়া, সূরা-মূলক, সূরা মুজ্জামিল) এই সূরাগুলো ।

নবী করিম (সা) বলেন, যে ব্যক্তি কোরআন শরীফের একটি অক্ষর পড়বে তার জন্য ১০ নেকী লিখা হবে। আমি এ কথা বলছি না যে, আলিফ লাম মীম একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর এবং মীম একটি অক্ষর। 

আল্লাহর প্রশংসা করা। আল্লাহ তায়ালার গুণগান গাওয়া।( লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্ হামদু ল্লিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আস্তাগফিরুল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুউআতা ইল্লা বিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়া। 

শবে কদরের ফজিলত – লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হাদিস

শবে কদর হচ্ছে সবচেয়ে ফযিলতপূর্ণ এবং শ্রেষ্ঠ রাত। এই রাতে পবিত্র কোরআন শরীফ নাজিল হয়েছে। 

শবে কদরের রাতে আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আঃ) ফেরেশতাদের একটি বিরাট বাহিনী নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। এবং যত নর-নারী আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকে তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,নবী করিম (সা) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে ইবাদত করে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)।

শবে কদরের ফযিলত ও মহাত্ম সম্পর্কে কোরআন মাজীদের সুরা কদরে যে বর্ণনা আছে ততটুকুই যথেষ্ট। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কদরের রজনীর ফযিলত সম্পর্কে তেমন কিছু বলেন নাই।          

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝার তওফিক দান করুন এবং শবে কদরে বেশি বেশি আমল করার তওফিক দিন। আমীন।

FAQs

শবে কদরের অর্থ কি

শব শব্দের অর্থ রাত বা রজনী এবং কদর শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা,মহিমান্বিত।অর্থাৎ শবে কদরের অর্থ হলো মর্যাদার রাত।

শবে কদর কবে বা কত তারিখে

শবে কদর আসলে কবে বা কখন সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে রমজান মাসের ২৭ তারিখ শবে কদর পালন করা হয়।

শবে কদরের নামাজের নিয়ম কি

শবে কদরের নির্দিষ্ট কোন নামাজ নেই। এই রাতে আপনি বেশি বেশি নফল নামাজ, তাসবিহ ও জিকির করতে পারেন