নামাজ কী? নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

নামাজ কী? নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

সালাত / নামাজ ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সার্বজনীন। একে দীনের খুঁটিও বলা হয়। নামাজ ছাড়া ইমান টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। একারণে আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা আমার স্মরণে সালাত আদায় কর।”

নামাজ কি বা নামাজ কাকে বলে?

ফারসি শব্দ নামাজ এর আরবি প্রতিশব্দ হলো সালাত। এর আভিধানিক অর্থ হলো –

  • প্রার্থনা করা
  • তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করা
  • দরুদ পড়া
  • ক্ষমা প্রার্থনা করা ইত্যাদি

পারিভাষিক সংজ্ঞা মতে সালাত কি

ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, “নির্দিষ্ট রুকন ও জিকিরসমূহকে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে আদায় করাকে সালাত বলে।”

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “দ্বীনের মস্তক ইসলাম এবং তার স্তভ হলো সালাত।”

মুজামূল ওয়াসীত গ্রন্থগার বলেন, “শরীয়াতে নির্ধারিত সময়ে ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত একটি নির্দিষ্ট ইবাদতের নাম সালাত।”

তানজীমুল আশতাত গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, “নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কিছু আরকান ও কাজের সমষ্টি সালাত।”

সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, নির্দিষ্ট কিছু আরকানসহ নির্ধারিত সময়ে আদাকৃত একটি ইবাদতের নাম নামাজ। যা সকল মুসলমানের উপর ফরজ।

সালাত কাকে বলে ?

যা দ্বারা মন পবিত্র হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় তা-ই নামাজ । আল্লাহকে স্মরণ করাই নামাজের উদেশ্য । মনকে আল্লাহর কাছ হতে দূরে রাখলে নামাজের উদ্দেশ্য সাধিত হয় না । প্রবৃত্তির বিষয়ে উচ্ছৃঙ্খল থেকে শুধু অজু গোছলের পবিত্রতা নিয়ে কেবল অঙ্গভঙ্গি দ্বারা নামাজ আদায় হয় না । নামাজ হৃদয়ের জিনিস ।

নামাজ কি ধ‍্যানের মত?

ধ্যান নামাজের একটি অংশ বলা যায় কিন্তু পুরো নামাজ টি ধ্যান বলা যাবে না। কারণ ধ্যান বলা হয় এক জায়গায় বসে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কোন কিছু জল্পনা-কল্পনা/চিন্তা করাকে । কিন্তু নামাজ এরকম নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু কাজের সমষ্টি যেমন রুকু, সেজদা, বৈঠক, কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল,তাশাহুদ ইত‍্যাদী মিলে হলো নামাজ।

মোটকথা আল্লাহর দরবারে নামাজ কবুল হওয়ার জন্য ধ্যানমগ্নতা মুখ্য নয় কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পাক-পবিত্র হয়ে অমুসলিম কেউও নামাজ আদায় করতে পারেন তবে তা একমাত্র আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যেই হওয়া উচিত।

নামাজ কত ওয়াক্ত এবং কোন ওয়াক্ত কত রাকাত?

দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ। ফরজের পাশাপাশি প্রত্যেক ওয়াক্তেই ওয়াজিব, সুন্নাত এবং নফল নামাজ রয়েছে। নামাজের মোট পাঁচ ওয়াক্ত নিচে দেয়া হলো –

১।ফজর নামাজ-৪ রাকাত/(২-রাকাত সুন্নাত + ২ রাকাত ফরজ।)
২।যোহর নামাজ-১২ রাকাত/(৪-রাকাত সুন্নাত + ৪-রাকাত ফরজ + ২-রাকাত ছোট সুন্নাত + ২-রাকাত নফল)
৩।আছর নামাজ-৮ রাকাত/(৪-রাকাত সুন্নাত||৪-রাকাত ফরজ)
৪।মাগরিব নামাজ-৭ রাকাত/(৩-রাকাত ফরজ + ২-রাকাত সুন্নাত + ২-রাকাত নফল)
৫।এশার নামাজ-১৭ রাকাত/(৪-রাকাত সুন্নাত + ৪-রাকাত ফরজ + ২-রাকাত ছোট সুন্নাত + ২-রাকাত নফল +  ৩-রাকাত বেতর+২-রাকাত নফল)

আরও পড়ুনঃ নামাজের জন্য প্রয়োজনীয় সূরা সমূহ পর্ব-১

নামাজ শিক্ষার ভূমিকা

আল্লাহ তা’আলা মানব জাতীকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। আর ইবাদতের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ । কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা নামাজের হিসাব নিবেন। নামাজ না পড়া জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।

তাইতো রাসূল সা. বলেছেন, ইচ্ছাকৃত নামাজ পরিত্যাগ কারী জাহান্নামী কারণ ইচ্ছাকৃত নামাজ পরিত্যাগ কারী কুফুরী। নামাজ একটি ফরজ এবাদত , এই ফরজ এবাদত আল্লাহ ও রাসূল সা. এর তরিকায় আদায় করতে হবে। কিন্তু দুঃখ-জনক হলেও সত্যি মুসলমানরা আজকাল ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজের মত গুরুত্বপূর্ণ এবাদতকে ছেড়ে দিচ্ছে আর যারা নামাজ পড়েন তারাও নিজেদের মন মত নামাজ আদায় করে থাকেন।

সহীহ তরিকা শিখার চেষ্টাও করে না । অথচ রাসূল সা. বলেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যারা সুন্দরভাবে আদায় করে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে পাঁচটি  বিশেষ পুরুস্কার দান করে সম্মানিত করবেন।

(১) তার থেকে মৃত্যু কষ্ট দূর করে দিবেন।

(২) কবরের শাস্তি থেকে তাকে মাফ করে দিবেন।

(৩) কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাকে ডান হাতে আমালনামা দান করবেন।

(৪) বিদ্যুতের গতিতে ফুলসীরাত পার করবেন।

(৫) বিনা হিসাবে জান্নাত দান করবেন।

অতএব সহীহ তরিকায় নামাজ কিভাবে পড়তে হয় তা শিখে নেওযা জরুরী। রাসূল (সা) কে আল্লাহ তা’আলা জিব্রাইল (আ) এর মাধ্যমে সহীহ তরিকার নামাজ পড়া শিখিয়েছেন।  আর  রাসূল (সা) নিজেও হযরত জিব্রাইল (আ) এর  দেখানো তরিকায়ই সব সময় নামাজ পড়তেন । কারণ এটিই ছিল আল্লাহ তা’আলার শিখানো তরিকা। হযরত সাহাবায়ে কেরাম (রা) রাসূল (সা) কে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছেন ঠিক সেভাবেই তারা নামাজ আদায়  করেছেন। কারণ এটাই নামাজের বিশুদ্ধ তরিকা। সম্মানিত পাঠক আসুন কিভাবে সহীহ তরিকায় নামাজ আদায় করতে হয় তা আমরা জেনে নেই।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে সুন্নতি পদ্ধতিতে সুন্দরভাবে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন আমীন।

সালাতের শিক্ষা

বান্দার কল্যাণের জন্য আল্লাহ তা’আলা দিন ও রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। এটি এমন একটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নাম, যা আত্মশুদ্ধিসহ জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে আলোচনা করে। যেকারণে সমাজের লোক সৎ, নিষ্ঠাবান,আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে।

আল্লাহ বলেন, “অবশ্যই মুসলিমগণ সফলকাম হয়েছে, যারা তাদের সালাতে বিনয় নম্র।”

নিম্নে সালাত বা নামজের শিক্ষাগুলো উল্লেখ করা হলো –

  1. আল্লাহর দেওয়া বান্দার উপর একটি ফরজ ইবাদত সালাত। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।” (সূরা মায়েদা- ১০৩)
  2. সালাত মিরাজের সমতুল্য। এটি আল্লাহর সাথে বান্দার সাক্ষাৎ লাভের অন্যতম মাধ্যম। হাদীসে এসেছে, “নামাজ মুমিনদের জন্য মিরাজস্বরূপ।”
  3. এর মাধ্যমে বান্দার আত্মিক উন্নতি সাধিত হয়। ফলে বান্দার মনে আল্লাহর ধ্যান ধারণা সদা জাগ্রত থাকে। আল্লাহ বলেন, “অর্থাৎ, আল্লাহর স্মরণই সর্বশেষ্ঠ।”
  4. নামাজ বান্দাকে নিয়মানুবর্তিতার জ্ঞানলাভে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ বলেছেন, “অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে।”
  5. এটি বান্দাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে এবং পারস্পরিক সংহতি বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন, “তোমরা রুকু কর রুকুকারীদের সাথে।”
  6. এটি মানুষকে অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত রাখে। আল্লহ বলেন, “অর্থাৎ, নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।”
  7. এটি মানুষকে কর্তব্যবোধ শিক্ষা দেয়।
  8. সালাত মানুষের অলসতা দূর করে।
  9. এটি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা জাগ্রত করে।
  10. এটি শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত করে।
  11. নামাজ সাম্যের শিক্ষা দেয়।
  12. সালাত জান্নাতের চাবিস্বরূপ।ইত্যাদি।

নামাজের গুরুত্ব
ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নামাজ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে বার বার নামাজের তাগিদ পেয়েছেন। কুরআনে পাকে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন জায়গায় সরাসরি ৮২ বার সালাত শব্দ উল্লেখ করে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

নামাজ হলো ইসলাম ধর্মের একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বা উপাসনা। এর মাধ্যমে বান্দা স্রষ্টার একেবারে নিকটবর্তী হয়ে যায়। সে অনুভব করতে পারে আমি আল্লাহর কাছে এসে গেছি আমি এখন যাই বলব তিনি তাই শুনবেন। হাদীস শরীফে এসেছে

الصلاة معراج المؤمنين

নামাজ হলো মোমিন বান্দা-বান্দিদের জন্য রব্বে কারীমের সাথে একান্তে কথা-বার্তা বলার একটি মাধ্যম। মুসলমানরা যখন নামাযে দাঁড়ায় আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তাকে তাঁর রহমতের চাঁদরে ঢেকে দেন। সিজদা অবস্থায় আমরা এমন এক অন্যরকম অনুপম শান্তি অনুভব করি যে, তখন স্রষ্টার কুদরতির সামনে সারা পৃথিবী কে একেবারেই তুচ্ছ মনে হয়।

নামাজের ফজিলত

মহান আল্লাহ পাকের নিকট নামায অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ্ পাকের নিকট নামায অপেক্ষা অধিক প্রিয় ইবাদত আর নাই। আল্লাহ্ পাক স্বীয় বান্দাগণের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিয়েছেন। যারা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায আদায় করে তারা পরকালে বেহেশতের মধ্যে অতি উত্তম স্থানে অবস্থান করিবে। এবং যাহারা নামায পড়েনা তাহারা জাহান্নামের নিকৃষ্টতম স্থানে অবস্থান করিবে।

প্রত্যেকেরই নামায পড়া একান্ত প্রয়োজন। নামায না পড়িলে আখেরাতে অর্থাৎ পরকালে এবং দুনিয়ায় প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হইতে হইবে। নামায কাহারও জন্য মাফ নাই। কোন অবস্থায়ই নামায বাদ দেয়া জায়েয নাই, রুগ্ন, বধির, খোড়া, আতুর, অন্ধ, বোবা যে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায়ই নামায আদায় করতে হবে। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন-

قَدْ اَلفْلَحَ الْمُؤْ مِنُوْنَ الَّذِيْنَ هُمْ صَلَوتِهِمْ خَاشِعُوْنَ

উচ্চারনঃ “ক্বাদ আফলাহাল মুমিনুনাল লাজিনাহুম ছালাতিহিম খাশিউন”।

হযরত আদম (আঃ) হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত দুনিয়াতে যত নবী রাসুল আসিয়াছেন তাঁহাদের প্রত্যেকের উপর এবং তাঁহাদের উম্মতদের উপর নামায পড়া ফরয ছিল। কোন নবীর প্রতি ১০ ওয়াক্ত, কারও প্রতি ৩০ ওয়াক্ত, কারও প্রতি ৫০ ওয়াক্ত, কারও প্রতি ৪০ ওয়াক্ত নামায ফরয ছিল। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যখন মেরাজে গমন করেন, তখন আললাহ্ পাক ৫০ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। কিন্তু আখেরী জামানার উম্মতগণ ৫ ওয়াক্ত নামায পড়িলেই ৫০ ওয়াক্ত নামাযের সওয়াব পাইবে। নামায আললাহ্ পাকের একটি উপহার। যাহারা আললাহ্ পাকের দেয়া এই উপহার অবহেলা করবে বা অবজ্ঞা প্রকাশ করবে তাহারা কখনই আললাহ্ পাকের প্রিয় বান্দা হইতে পারবে না।

আল্লাহ্ পাক নামাযের ফজিলত সম্মন্ধে কোরআন পাকে বলেছেন—

وَالَّذِيْنَ هُمْ عَلَى صَلَوتِهِمِِ يُحَا فِظُوْنَ اُولَئِكَفِىْ جَنَّتِمُّكْرَمُوْنَا

উচ্চারনঃ ওয়াল্লাজিনা হুম আলা ছালাওয়াতিহিম ইউহাফিজুনা উলাইকা ফি জান্নাতিম মুকরামুন।

অনুবাদঃ যে সমস্ত লোক যত্ন সহকারে নামায আদায় করবে তাহারাই বেহেশতে যাইবে এবং অশেষ সম্মানের অধিকারী হইবে। নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায যেমন তোমাদের বাড়ীর সামনে দিয়া প্রবাহিত একটি নদীর মত। তোমরা যদি প্রতিদিন ৫ বার ঐ নদীতে গোসল কর, তবে যেমন তোমাদের শরীরে কোন ময়লা-আবর্জনা থাকতে পারেনা, তেমনি যে ব্যক্তি পাঁচ বার নামায পড়ে কোন প্রকার পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারেনা। নবী পাক (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আরও বলেছেন, যখন কোন ব্যক্তি ভক্তি সহকারে অজু করে, ভয় মিশ্রিত ভাবে নামায পড়ে, আল্লাহ্ পাক তাহার জন্য দোযখের আগুন হারাম করে দেন। কিয়ামতের দিন নামাযই ঐ ব্যক্তিকে দোযখের আগুন হইতে বাঁচাইয়া বেহেশতে নিয়া যাইবে। নামায পড়ার সময় যদি কপালে ধুলা মাটি ভরিয়া যায় তবে তাহা পরিস্কার করবেনা। কারণ যতক্ষন না মাটি কপালে থাকে ততক্ষণ আল্লাহ পাকের রহমত বর্ষিত হইতে থাকে।

কার উপর কোন নামায ফরয করা হয়েছিল

হযরত আদম (আঃ) এর উপর ফজরের নামায, হযরত দাউদ (আঃ) এর উপর জোহরের নামায, হযরত সোলায়মান (আঃ) এর উপর আছরের নামায, হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর উপর মাগরিবের নামায, এবং হযরত ইউনুছ (আঃ) এর উপর এশার নামায ফরয করা হয়েছিল। যে ব্যক্তি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিকমত ভক্তি এবং আল্লাহ ভীতি সহকারে আদায় করবে, সে উপরের পাঁচজন নবী রাসূলের সমান সওয়াব পাবে।

নামায সম্পর্কিত হাদীস

হাদীসে বর্ণিত আছে,

“যে ব্যক্তি ভালভাবে ওযু করে ভয় ও ভক্তি সহকারে মনোযোগের সহিত রীতিমত নামায আদায় করে কিয়ামতের দিন আললাহ্ পাক তাহার সগীরা গুনাহ্ সমূহ মাফ করে দিবেন এবং বেহেশতের উত্তম জায়গায় স্থান দিবেন।”

  • অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

“নামায দ্বীন (ইসলামের) খুঁটি স্বরূপ”।

অর্থাৎ ঘর যেমন খুটি ছাড়া তৈরী হয় না বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। ঠিক তেমনি ইসলামরূপ ঘর ও নামায নামক খুঁটি ছাড়া টিকতে পারেনা। যে ঠিকমত নামায কায়েম করল সে ইসলামকে কায়েম রাখিল। আর যে নামায কায়েম করল না সে যেন দ্বীনকে ধ্বংস করে দিল।

  • অন্য হাদীসে আছে,

“কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম নামাযের হিসাব নেওয়া হবে। নামাযী ব্যক্তির হাত, পা, মুখমন্ডল কেয়ামতের দিন সূর্যের আলোর মত উজ্জল হবে। কিন্তু বেনামাযীর ভাগ্যে তা জুটিবে না।”

হাদীসে বর্ণিত আছে, কিয়ামতের ময়দানে নামাযীগণ নবী, শহীদ ও অলীগণেরর সঙ্গে থাকিবে। এবং বেনামাযীরা ফেরাউন, সাদ্দাদ, হামান, কারূনের এবং আরও বড় বড় কাফেরদের সাথে থাকবে।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমার সাথে আলাপ করছিলেন, এমন সময় নামাযের ওয়াক্ত হইল। তিনি তখনই উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার শরীরের রং এবং চেহারা পরিবর্তন হইয়া গেল। তাঁহার ভাব দেখিয়া আমার মনে হইতেছিল তিনি আমাকে চিনিতে পারিতেছেন না। আমি নবী পাক (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে ইহার কারণ জিজ্ঞাস করলে তিনি বলিলেন, হে আয়েশা! ইহা আললাহ পাকের আদেশ প্রতি পালনের সময়। এসময়ে প্রত্যেকের এই আহবানে ভয় হওয়া উচিত।

নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন কোন বান্দা অযু করিয়া জায়নামাযে দাঁড়ায়, তখন আল্লাহ পাক একজন ফেররেশতাকে পাঠাইয়া তাকে বলিয়া দেন যে, আমার অমুক বান্দা নামায পড়িবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে, কিন্তু তাহার শরীরের পূর্বের পাপরাশি সঞ্চিত আছে। নাপাক জিনিস সাথে করে নামায পড়িলে তাহার নামায শুদ্ধ হইবে না। তুমি উহার শরীর হইতে সমস্ত পাপ তোমার মাথায় লইয়া দাঁড়াইয়া থাক। আর আমার বান্দা নিস্পাপ অবস্থায় নামায আদায় করুক। আল্লাহ্ পাকের আদেশ অনুযায়ী উক্ত ফেরেশতা তাহার সমস্ত পাপ উঠাইয়া নিজের মাথায় লইয়া দাঁড়াইয়া থাকে। তারপর নামায পড়া শেষ হইলে ফেরেশতা বলে হে আল্লাহ্! আপনার বান্দার নামায পড়া শেষ হয়েছে। তাহার পাপগুলি এখন তাহার শরীরে ছাড়িয়া দেই। আল্লাহ পাক বলেন, আমার নাম ‘রাহমানুর রাহিম’ আমি বান্দার শরীর হইতে পাপের বোঝা নামাইয়া আবার যদি সেই বোঝা তাহাকে চাপাইয়া দেই তবে আমার রাহমান নামের স্বার্থকতা থাকেনা। হে ফেরেশ্তা! আমার এ বান্দার পাপের বোঝা দোযখে নিক্ষেপ করিয়া জ্বালাইয়া দাও। এখন হইতে আমার এই বান্দা নিস্পাপ।

একদিন নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সাহাবাগণের সহিত বসিয়া আছেন। এমন সময় একন ইহুদী আসিয়া বলিল, হে মুহাম্মদ (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ! আপনাকে আমি একটি প্রশ্ন করব। আপনি যদি তাহার উত্তর দিতে পারেন তবেই বুঝিব যে আপনি সত্যিই আল্লাহর নবী। কেননা কোন নবী ব্যতীত আমার এই প্রশ্নের উত্তর কেহই দিতে পারবে না। তখন নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলিলেন তোমার প্রশ্ন কি? ইহুদী বলিল, আপনার ও আপনার উম্মতের উপর যে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায নির্দিষ্ট করা হয়েছে ইহার তত্ত্ব কি? নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বললেন, সূর্য যখন পশ্চিম আকাশের দিকে চলিয়া যায় তখন প্রথম আসমানে একদল ফেরেশতা আল্লাহপাকের ইবাদতে লিপ্ত হয়। ঐ সময় সমস্ত আসমানের দরজা খোলা থাকে। মানুষ ও সমস্ত ফেরেশতাদের ইবাদত আল্লাহ্ পাকের দরবারে পোঁছায়া যায়। জোহরের সময়ে আল্লাহ্র নিকট সকল ইবাদত কবুল হয়। ঐ সময়ে নামাযের আদেশ হওয়ার উদ্দেশ্য হইল, উক্ত সময়ে নামায পড়লে শয়তান কোন প্রকারে ধোকা দিতে পারবেনা। মাগরিবের ওয়াক্তে হযরত আদম (আঃ) এর তওবা কবুল হইয়াছিল। উক্ত সময়ে নামায পড়িয়া আল্লাহ পাকের নিকট যে দোয়া করিবে আল্লাহ পাক তাহা কবুল করিবেন। এশা ওয়াক্ত এমনি সময় যখন আমার পূর্ববর্তী সমস্ত নবীগণের ও তাঁহাদের উম্মত গণের উপর এশার নামায ফরয ছিল। এই নামায পড়িলে সমস্ত পয়গাম্বরের উপর নির্দিষ্ট নামাযের ছওয়াব পাওয়া যায়। আর ফজরের ওয়াক্তের মর্ম এই যে, যখন সূর্য উদিত হয় তখন উহা শয়তানের মাথার উপর দিয়া উদিত হয়। সেই সময় কাফের মোশরেকগণ তাহাদের দেব দেবীদের উদ্দেশ্য করে শয়তানকে সিজদাহ করে থাকে। আল্লাহ্ পাক আমাকে এবং আমার উম্মতগণকে উহার পূর্বেই নামায পড়িতে আদেশ করেছেন। এই কথা শুনিয়া ইহুদী বলিল, আমি বুঝিলাম আপনি সত্যই আল্লাহর নবী। তারপর সেই ইহুদী তার দলবল লইয়া মুসলমান হইয়া গেল।

নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

“তুমি যখন নামাযে দাঁড়াইবে তখন মনে মনে এইরূপ ধারনা করিবে যে আমি আল্লাহ পাকের সামনে দাঁড়াইয়াছি। যদিও আমি তাঁহাকে দেখিতেছিনা কিন্তু তিনি আমাকে দেখিতেছেন।”

এক যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) এর পায়ে তীর বিদ্ধ হইয়াছিল। তিনি তীরের আঘাতের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া পড়িলেন। অনেক চেষ্টা করিয়াও তীর বাহির করতে পারছেন না। নামাযের সময় হযরত আলী (রাঃ) নামাযের নিয়ত করলে নবী করীম (সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর ইশারায় কয়েক জন ছাহাবা সজোরে টানিয়া তীরটি বাহির করিয়া ফেলিলেন। রক্তে জায়নামায ভিজিয়া গেল। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) ইহার কিছুই টের পেলেন না। নামায শেষে জায়নামাযে রক্ত দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন ইহা কিসের রক্ত।

আল্লাহ্ পাকের নিকটতম বান্দাগণের নামায সাধারণতঃ এই রকমই হয়ে থাকে। নামাযের ফজিলত বলে শেষ করা যাবে না। তাই মুসলমান ভাইদেরকে সাবধান করে দিতেছি নামায ছাড়া পরকালে পার পাওয়া যাবেনা। ইহকাল এবং পরকাল উভয় কালে শান্তি ও সুন্দর পথচলার জন্য এবং মুসলমান হিসেবে নামাজ পড়া আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

পরিশেষে…

নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিন মুসলমানের ঈমানের দাবি ও ফরজ ইবাদত। নামাজি ব্যক্তিই হলো পৃথিবীর প্রকৃত সফল ব্যাক্তি। যার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন প্রিয়নবি। তিনি বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান থাকে; কেয়ামতের দিন ওই নামাজ তার জন্য নূর হবে এবং হিসেবের সময় নামাজ তার জন্য দলিল হবে এবং নামাজ তার জন্য নাজাতের কারণ হবে।

পক্ষান্তরে

যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান হবে না- কেয়ামতের দিন নামাজ তার জন্য নূর ও দলিল হবে না। তার জন্য নাজাতের কোনো সনদও থাকবে না। বরং ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সাথে তার হাশর হবে।’

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সহিহ তরিকায় সঠিক পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। ফরজ নামাজ আদায়ের পাশাপাশি নফল নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। নামাজকে পরকালের নাজাতের ওসিলা বানিয়ে দিন। আমিন।

FAQs

নামাজ শব্দের অর্থ কি

নামাজ শব্দের অর্থ দোয়া, ক্ষমা, প্রার্থনা করা। নামাজের আরবি হল সালাত।

নামাজ কাকে বলে

যা দ্বারা মন পবিত্র হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় তা-ই নামাজ ।

কোন ওয়াক্তে কত রাকাত নামাজ

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ফজর ৪ রাকাত, যোহর ১২ রাকাত, আছর ৮ রাকাত, মাগরিব ৭ রাকাত এবং এশা ১৭ রাকাত।

নামাজের ওয়াজিব কয়টি

নামাজের ওয়াজিব ১৪ টি।

নামাজের সুন্নত কয়টি

নামাজে ২১ টি সুন্নত রয়েছে।

নামাজের নিষিদ্ধ সময় কয়টি

নামাজের নিষিদ্ধ সময় তিনটি। ১. সূর্যোদয়ের পর থেকে এশরাকের আগ পর্যন্ত। ২. সূর্য যখন মাথার ওপরে।
৩. সূর্য ডোবার সময়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *