‘মাথার চুল ঝরে পড়া’ বিশ্বব্যাপী এটি এক অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্যের অভাব, রাতে ঠিক মত না ঘুমানো, আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে নারী, পুরুষ উভয়রই প্রতিদিন অসংখ্য চুল ঝরে পড়ছে। আজ আমরা জানবো চুল পড়া বন্ধ করার উপায় গুলো কি কি। তবে তার আগে জানা দরকার চুল কেন পড়ে।
এই আর্টিকেলে রয়েছেঃ ⇒ চুল পড়ার কারণ ⇒ চুল পড়া রোধে করণীয় ⇒ চুল পড়া বন্ধে প্রাকৃতিক উপায় ⇒ চুল পড়া বন্ধে ঘরোয়া পদ্ধতি ⇒ চুল পড়া বন্ধে কার্যকর খাবার ⇒ চুল পড়া বন্ধে কৃত্রিম উপায় ⇒ চুল পড়া বন্ধে কিছু কার্যকর তেল
চুল পড়ার কারণ
প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি চুল ঝরে পড়া স্বাভাবিক বিষয়। তবে এর অতিরিক্ত চুল ঝরে পড়লে তা স্বাভাবিক নয়। চুল বিভিন্ন কারণে পড়ে যেতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো –
১। বংশগত কারণে।
২। সুষম খাদ্যের অভাব।
৩। অতিমাত্রায় ওষুধ সেবনের কারণে।
৪। মাথার ত্বকে ইনফেকশনের কারণে।
৫। হরমোনের পরিবর্তন হলে।
৬। চুলে ক্ষতিকারক কেমিক্যাল ব্যবহার করলে।
৭। চুল টানলে বা শক্ত করে বাঁধলে।
৮। থাইরয়েডের সমস্যা হলে।
৯। ভেজা অবস্থায় চুল চিরুনি করলে।
১০। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করলে।
নারী পুরুষ উভয়েরই চুল পড়ার কারণগুলো প্রায় একই রকম। তবে নারীদের গর্ভাবস্থায়, মেনোপজের সময় এবং বাচ্চা হবার পর হরমোনের পরিবর্তন বেশি দেখা যায়। এতে সেই সময় তাদের চুল পড়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া জন্ম নিয়ন্ত্রণের ঔষধ অতিরিক্ত পরিমাণে খাবার ফলে চুল ঝরে পড়ে।
পুরুষদের চুল সাধারণত মাথার সামনের দিক থেকে পড়ে আর নারীদের মাঝখান থেকে। তাই পুরুষদের চুল পড়লে তা সহজে বুঝা যায়।
চুল পড়া রোধে করণীয়
কিছু কাজ করলে চুল পড়া আপনা-আপনিই কমে যায়। যেমনঃ
১। সুষম খাদ্য খাওয়া ২। সঠিক ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা এবং নিয়মিত ব্যয়াম করা। ৩। চুলে কেমিক্যাল জাতীয় উপাদান ব্যবহার না করা। ৪। নিয়মিত চুলে শ্যাম্পু করা। ৫। শ্যাম্পুর পর ভালো কন্ডিশনার ব্যবহার করা। ৬। চুলে তেল দেওয়া। ৭। মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করা। ৮। মোটা তোয়ালা চুলে পেঁচিয়ে না রাখা। ৯। নিয়মিত চুলের যত্ন নেওয়া। ১০। চুল শক্ত করে না বাঁধা।
চুল পড়া বন্ধের উপায়
অমুক তেল ব্যবহার করলে চুল দড়ির মত শক্ত হবে। তমুক তেল মাথায় দিলে বয়স ২০ বছর কমে যাবে! এরকম হাজারো এড দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এগুলো কোনটাই কাজের না। বিজ্ঞানসম্মত কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিতেই চুল পড়া বন্ধ করা সম্ভব।
তাহলে চলুন চুল পড়া বন্ধ করার সহজ ২০ টি উপায় সম্পর্কে জেনে নিই।
**চুল পড়া বন্ধে প্রাকৃতিক উপায়
১) এ্যালোভেরা –
দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাক্ষেত্রে এ্যালোভেরা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চুল পড়া রোধে সপ্তাহে এক-দুই দিন মাথার ত্বকে এ্যালোভেরা জেল লাগানো যেতে পারে।
২) পেঁয়াজের রস –
পেঁয়াজের রস নিয়মিত ব্যবহারে চুল পড়া নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কয়েকটি পেঁয়াজ খোসা ছাড়িয়ে ব্লেন্ড করে রস বের করে নিতে হবে। প্রয়োজনে সামান্য পানি মিশিয়ে তা মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু করে ফেলতে হবে।
৩) মেহেদি –
চুল পড়া রোধে মেহেদি একটি কার্যকর উপাদান। মেহেদি পাতার পেস্ট চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগিয়ে দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। এরপর শ্যাম্পু করে ফেলতে হবে।
৪) লেবু –
লেবু চুল পড়া রোধে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাজা লেবুর রস মাথার ত্বকে লাগিয়ে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৫) নিম পাতা –
নিম পাতার পেস্ট তৈরি করে তা চুলে এক ঘন্টার জন্য লাগিয়ে এরপর ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে দুই-তিন দিন এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে চুল পড়া বন্ধ হবে এবং চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।
৬) নারিকেল দুধ –
নারিকেল দুধে রয়েছে অতিমাত্রায় প্রোটিন, পটাসিয়াম, আয়রন, যা চুল পড়া রোধে এবং বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এক কাপ কাঁচা নারকেলের দুধ ভালোভাবে চুলে লাগিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য রাখতে হবে। এরপর পানি দিয়ে তা ধুয়ে ফেলতে হবে।
আরও পড়ুনঃ ওজন কমানোর উপায় : সহজেই দ্রুত ওজন কমানোর ২২টি টিপস
**চুল পড়া বন্ধে ঘরোয়া পদ্ধতি
৭) ডিম, মধু ও অলিভ ওয়েলের মিশ্রণ –
ডিমে অধিক পরিমাণে সালফার, ফসফরাস, আয়োডিন, জিংক ও প্রোটিন থাকে। যা চুল ঝরে পড়া রোধ করে। একটি বাটিতে ডিমের সাদা অংশ নিয়ে এতে এক চামচ মধু ও এক চামচ অলিভ ওয়েল দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হবে। এরপর চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগিয়ে ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর শেম্পু করে ফেলতে হবে।
৮) গ্রিন টি –
গ্রিন টি অধিক পরিমাণ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা চুল পড়া রোধে সহায়তা করে। চুলের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে ২-৩ টি ব্যাগ ১-২ কাপ গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ঠান্ডা হলে মাথার তালু ও চুলে ম্যাসাজ করে লাগাতে হবে। এক ঘন্টা পর স্বাভাবিক পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৯) দই ও লেবুর মিশ্রণ –
দই এবং লেবু প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এবং এটি খুশকি দূর করতে সাহায্য করে। এতে করে চুল পড়া কমে যায়। পরিমাণমতো দই এর মধ্যে লেবুর রস ভালোভাবে মিশিয়ে চুলে লাগাতে হবে এবং ৩০ মিনিট পর মৃদ গরম পানি দিয়ে শ্যাম্পু করে ফেলতে হবে।
১০) মেথি –
চুল পড়া রোধে মেথি একটি কার্যকর উপাদান। মেথির মিশ্রণ তৈরি করতে পরিমাণমতো মেথি সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর এটির পেস্ট তৈরি করে চুলের ত্বকে ৩০ মিনিটের জন্য লাগিয়ে রাখতে হবে। ৩০ মিনিট পর স্বাভাবিক পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। একমাসে সপ্তাহে দু’দিন মেথির মিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে। এই মিশ্রণ ব্যবহারের পর শ্যাম্পু করা যাবে না।
১১) মধু ও নিমপাতার মিশ্রণ –
নিমপাতার রস বের করে এর সাথে মধু মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত লাগিয়ে ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর শ্যাম্পু করতে হবে। সপ্তাহে তিনদিন এটি ব্যবহার করা যাবে।
১২) কলা, তেল ও মধুর মিশ্রণ –
কলায় অধিক পরিমাণে পটাসিয়াম, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, প্রাকৃতিক তেল এবং ভিটামিন রয়েছে, যা চুল পড়া বন্ধ করতে সাহায্য করে। এই মিশ্রণটি তৈরি করতে দুটি পাকা কলা, এক টেবিল চামচ অলিভ ওয়েল, এক টেবিল চামচ কোকোনাট ওয়েল, এক টেবিল চামচ মধু ভালোভাবে মিশিয়ে মাথার ত্বকে। পাঁচ মিনিট পর হালকা গরম পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে।
**চুল পড়া বন্ধে কার্যকর খাবার
১৩) প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার –
চুল পড়া বন্ধ করতে হলে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হলো – ডিম, মাছ, মাংস, ডাল, বাদাম ইত্যাদি।
১৪) ওমেগা ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার –
বাদাম, আখরোট, মাছ, তিসি বীজ। এগুলো চুল পড়া বন্ধ করতে সহায়তা করে।
১৫) আয়রন সমৃদ্ধ খাবার –
চুল পড়া বন্ধ করতে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। শাক সবজি, শস্যদানা, মাছ, মাংসে প্রচুর আয়রন রয়েছে।
১৬) বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার –
বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার চুল পড়া বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার হলো – বাদাম, ডিমের কুসুম, অপরিশোধিত চাল ইত্যাদি।
চুল পড়া বন্ধে কৃত্রিম উপায়
১৭) ভিটামিন-ই ক্যাপসুল ব্যবহার –
বিভিন্ন হেয়ার মাস্কের সাথে ভিটামিন-ই ক্যাপসুল মিশিয়ে ব্যবহার করলে তা চুল পড়া বন্ধ করতে সহায়তা করে। এছাড়া তেলের সাথেও মিশিয়ে এটি মাথার ত্বকে ব্যবহার করা যায়।
১৮) প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা থেরাপি –
এন্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়ার কারণে চুল পড়ে গেলে সাধারণত ডাক্তাররা “প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা থেরাপি ” বা PRP চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
১৯) লো লাইট লেজার থেরাপি বা LLLT –
এটি একটি আধুনিক অস্ত্রোপাচারহীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। চুল পড়া বন্ধ করতে ও বৃদ্ধিতে এই লেজার থেরাপি ডাক্তাররা দিয়ে থাকেন।
**চুল পড়া বন্ধে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত ঔষধ এর নাম হলো - মিনোক্সিডিল। এটি ক্রিম, ফোম বা স্প্রে আকারে হয়ে থাকে। এছাড়া আরেকটি ঔষধ হলো ফিনোস্টেরাইড। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত এসব ঔষধ ব্যবহার করা মোটেও ঠিক নয়। কারণ এসব ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনু্যায়ী এগুলো ব্যবহার করা উচিৎ। **
তাছাড়া চুল পড়া রোধ সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারবেন এই আর্টিকেল পড়ে।
২০) চুল পড়া বন্ধ করতে কিছু কার্যকর তেল
চলুন জেনে নিই চুল পড়া বন্ধ করার তেলের নামঃ
১। অলিভ অয়েল। ( Olive Oil ) ২। ক্যাস্টর অয়েল। ( Castor Oil ) ৩। রোজমেরি অয়েল। ( Rosemery Oil ) ৪। ল্যাভেন্ডার অয়েল। ( Lavender Oil ) ৫। ফিশ অয়েল। ( Fish Oil ) ৬। কোকোনাট অয়েল ( Coconut Oil )
এই সব কার্যকরী তেল সম্পর্কে বিস্তারিত জনুন আর্টিকেলটি পড়ে।
চুল পড়া বন্ধ করার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চুল পড়ার বন্ধ করার সমাধানতো পেয়ে গেলেন। এখন খুব সহজেই এগুলো অনুসরণ করে আপনি নিজেই হয়ে যান হেয়ার স্পেশালিষ্ট।